আমাদের বেলবটম যুগ/ পুরানো সেই দিনের কথা...২
আমাদের সময়ে ছিল বেলবটম যুগ। যুগ মানে সময়। এই স্টাইলটা হঠাৎ করেও আসেনি, আবার হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়নি। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তা আবার চেঞ্জ হয়ে যায়। অতি সম্প্রতি মেয়েদের প্লাজোর (পাজামা) কথা ধরা যেতে পারে। বছর দশ বা পনেরো আগে মেয়েদের পাজামা দেখলে মনে হতো পাজামা নয়, যেন লুঙ্গি--মাঝবরাবর একটা সেলাই আছে, অতটা লক্ষ না করলে বুঝা যেত না। সর্বত্র এই প্লাজো পরার প্রতিযোগিতা। মেয়েরা, মায়েরা এমন কি কাজের মহিলারাও প্লাজো পরার জন্য পাগল হয়ে যেত। আমাদের বেলবটম যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার আগে প্লাজো শেষ পরিণতি না বলে পারছি না। একবার ফেসবুকে দেখলাম একটি ছবি। এখনকার শহরের মানুষ এই ছবিটির সঙ্গে খুব বেশি পরিচিত নয়। ছবিটা হচ্ছে গ্রামের পায়খানা। গ্রামে পায়খানায় চারদিকে টিনের বেড়া থাকলেও সামনের দিকটা ছালা (বস্তা) দিয়ে আড়াল করার প্রচেষ্টা থাকত। একদিন ফেসবুকে দেখলাম এক দুষ্টু লোক ও-রকম পায়খানা ঘরের একটি ছবি দিয়ে সামনে দরজার বদলে ছালার মতো করে প্লাজো টানিয়ে দিয়ে ক্যাপসনে লিখেছে ‘প্লাজোর শেষ পরিণতি।’ বুঝুন দুষ্টুমি কাকে বলে!
আমাদের বেলবটমের পূর্বে ছিল টেডিস্টাইল-টেডি পাজামা। সেটা এখনো আছে। পাজামা পায়ের কাছে খুবই চিপা এবং সার্টটা অনেকটা খাটো। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের মধ্যে এর প্রচলন রয়েছে এখনো।
এবার বেলবটমের কথায় আসা যাক। ছবিতে দেখৃুন কী বিচিত্র পোশাক। হ্যাঁ আমরা এই ড্রেস পরেছি। এখন আমাকে লাখ দিয়েও এমন অদ্ভুত পোশাক পরাতে পারবেন না। প্যান্টের সঙ্গে একটা চওড়া বেল্ট পরা হতো। হাঁটু থেকে শুরু করে প্যান্ট নিচের দিকে পায়ের গোড়ালিতে ৩২/৩৪ ইঞ্চি ঘের থাকতো। একবার আমি একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যাওয়ার জন্য (আমার এলাকা মঠবাড়িয়ায়) বের হয়েছি। সামনে পরলেন তিনজন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন আমার প্রাইমারি স্কুলের টিচার বারেক স্যার। তিনি আমাকে দেখে বললেন, ‘কী পরেছিস ওর মধ্যে তো আমিও ঢুকে যেতে পারি। তখন আমার এলাকায় এই স্টাইলটা ছিল না বললেই চলে। সে ১৯৭৮ সালের কথা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় তখনকার এই স্টাইলটার সঙ্গে আমাকে খাপ খাওয়াতে হয়েছিল।
এখন যেমন সুতি কাপড় পরার জন্য মানুষ খুব উৎসাহী একটা সময় এমনটা ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩৫/৬৫ এবং ৮০/১০ টেট্রন বাংলাদেশের বাজারে আসে। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের স্কুলের গরীব মেধাবী ছাত্ররা টেট্রন কাপড়ের একটি জামার পিস পেতো। তখনকার দিনে এই টেট্রন সাধারণে পরতে পারত না। আমার আজও মনে আছে কাপড়ের রং ছিল হালকা সবুজ ও হালকা গোলাকী। আমি কিন্তু এই সুযোগ পাইনি। তবে আমার চেয়ে ধনী ও আমাদের বাজারে কাপড়ের ব্যাবসা আছে এমন এক শ্রেণিবন্ধু এই সুযোগটা নিয়ে ছিল । এ দেশের শুরু থেকেই সুবিধাবাদীরা ছিল এবং এখনো আছে। এই টেট্রনের আগে এক ধরনের কাপড় বাজারে প্রচলন শুরু হয়, যেটার নাম ক্যারোলিন। আহা সেকি উন্মাদনা ক্যারোলিন নিয়ে। অনেক দামী কাপড়। অনেকটা পাতলা কাপড়। পরতে নাকি খুব আরাম। আমি পরে দেখিনি--আমার বাবার সে সামর্থ ছিল না। তবে আমাদের বাড়িতে তিনজন ক্যারোলিনের জামা পরেছিল। একজন আমার চাচাতো ভাই, একজন আমার ছোট চাচা--দুজনই আজ পরাপারে। আল্লাহ তাদের বেহেস্ত নসিব করুন। আর একজন ভাইয়া--আমার বড়ো ভাই। তিনি ছোটবেলা থেকেই খুব স্টাইলিস্ট। এই তিন ব্যক্তি বাজারে ধান বিক্রি করে ক্যারোলিন কেনার টাকা জমিয়েছিলেন।
আমার ভাইয়ার কথা আর কী বলব। পোশাক-পরিচ্ছদে তিনি খুব স্মার্ট। তার মাথা আচড়ানোর চিরুনি ছিল ‘ডাক্কু’ কোম্পানি। এটা হাড়ের তৈরি। খুব সম্ভবত যশোরে এর কারখানা ছিল। ভাইয়ার মাথার তেল ছিল তিব্বত কোম্পানির ‘মেডিকেটেড হেয়ার অয়েল’। দারুণ সুগন্ধি আছে তেলটার। আমিও ব্যবহার করেছি অনেক দিন। এখনও আমি মাথায় কোনো তেল ব্যবহার করি না। এ ছাড়া তিনি খুব ভোজনরসিক। খাওয়া দাওয়া প্রায়ই হোটেলে করতেন। হোটেলে তার খাওয়ার বিল মেটাতে বাবাকে খুব সমস্যায় পরতে হতো।
পোশাক-স্টাইল বদলায়, তবে মানুষ বদলায় না। আমরা এখনো স্বাধীন হতে পেরেছি বলে মনে হয় না। কোথায় যেন একটা গলদ রয়ে গেছে। ৫৩ বছর আগে যে স্বাধীনতা আনতে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল, ২ লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছিল পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের হাতে, সেই পাকিস্তানের প্রতি আমাদের অনেকের দরদ উছলে উঠতে দেখি। হায় স্বাধীনতা! কী চেয়েছিলাম, কী পেয়েছি আজ!
২৫ এপ্রিল, ২০২৫